ষষ্ঠ বর্ষ। প্রথম সংখ্যা জানুয়ারি - মার্চ ২০২৪

গল্প

রেশমা-র লকডাউন

সুকৃতি

দক্ষিণ দিক থেকে গ্রামে ঢুকলে রাস্তার ডানধারের বাড়িগুলোর পেছনে বর্ডার পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সবুজ মাঠ। বামদিকের বাড়িগুলোর পেছনে চোখে পড়ে আম-জাম, বাঁশ-কাঠালের বড় বড় বাগান... হাঁটাহাঁটি দৌড়ঝাপ হয়না বলেই বৃষ্টির জল পেয়ে আগাছাগুলো কেমন তরতর করে সতেজে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। পাখি আনন্দে গায়, নিশ্চিন্তে খায় পোঁকামাকড় থেকে পাকা ফল পর্যন্ত। একা একটি ছেলে, উসকোখুসকো চুল, মলিন খালি গা, চোখগুলো যেন ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। জনশূন্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে শীর্ণ হাড়গিলে, কাঁদামাখা গায়ের নেড়িকুত্তার জিভে অপেক্ষাকৃত অধিক গতিতে লালানিঃসরণ হতে থাকে...শিশুটি প্রথমে অবাক হয়ে পরে ভীত হয়।

রাস্তার দুধারে সারে সারে বাড়িঘর, বেশিরভাগই ইটগাঁথা, নতুন। অজানা ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণের ভয়ে সবাই সবাইকে এড়িয়ে চলে। নিঝুম রাতের মত, সকাল থেকে সন্ধে সারাটা দিন প্রায় স্তব্ধ। দিনে দু-একবার গরুর ঘাসওয়ালার চেঁচানো আর ফল-আনাজওয়ালার দু-তিনবারের হাঁক শোনা যায়। কত খরতপ্ত জ্যৈষ্ঠের দুপুরের দইওয়ালার ‘দইদই’ হেঁকে যাওয়ায় গৃহস্থ চাষীর মনে পুলক জাগত, চুড়িওয়ালার ‘চুড়ি চাই চুড়ি চাই’ শব্দে কিশোরী অনাবিল আনন্দে ঘর ছেড়ে বাইরে আসত। আজ আর তেমন হয়না। তবু আজও বোধহয় জানালা-দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বহু আবালবৃদ্ধের চোখ উঁকি দিয়ে গভীর আগ্রহে পথের দিকে চায়।

গ্রামটির নাম কল্পতরু। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষকেই সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাদ রেখে রাতদিন বিভোর করে রেখেছে এক গভীর দিবাস্বপ্ন। পেটের ক্ষুধা মেটানোর স্বপ্ন।

মোড়ের মাথায় রাস্তা শেষে দুধারে সারে সারে পঞ্চাশ খানেক দোকান। বেশির ভাগই পাকা। রহমানের চায়ের দোকানটা বাঁশের চাটাইয়ের। বাঁশের ঝাপ, বাঁশের ধরাট। পুরোনো টিনের চাল মরচে ধরা। সামনেটায় পাটকাঠির ছাউনির উপর ত্রিপলটার মাঝে মাঝেই ফাটাফুটি। গতরাত্রে বিশ মিনিট ধরে ঝড়ের গোঁ গোঁ গোঙানির পর ছাউনিটা নুইয়ে পড়েছে। রহমান ঝাপে ঠেস দিয়ে ধরাটে বসে আছে। দোকানের মেঝের সামনেটায় রাস্তার ধুলো, শুকনো ছেঁড়া পাতা, শিমুলগাছের ছড়িয়ে পড়া তুলো, প্লাস্টিক কাগজে ভরে আছে। চা খেতে কেউ আসবেনা, তাই ঘর সারানোর বালাই নেই, ঝাঁট দেওয়াও দরকারি মনে হয়না। আড়াইমাস থেকে রোজগারের পথ খুইয়েছে রহমান। রোজ খুব সকালে উঠে সে এভাবে বসে বসে পিচ গলানো রাস্তার দিকে আনমনে চেয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই ডোবা হয়ে আছে... উপরের দেড়সেমি মাপের নতুন প্রলেপ উঠে গিয়ে ভেতরের কলঙ্ক চকচক করে রেরিয়ে আসে। পাড়ার একটা দুরন্ত ছেলে, ছ-সাত বছর বয়স হবে হয়ত, পায়ের আঘাত দিয়ে গর্তের জলগুলো যতদূর সম্ভব চারদিকে ছিটিয়ে নিজের অদ্ভূত শক্তির ক্ষমতায় অসম্ভব গর্ব অনুভব করে– যেদিকে জল জমে আছে সেদিক দিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দে খেলতে খেলতে চলে যায়। ছোটবেলার ডানপিটে আর বাউণ্ডুলেপনার স্মৃতিকে সেকেণ্ডে অতিক্রম করে সেই সন্ধ্যাবেলার মেঝে-পাতা বিছানায় শুয়ে দাদির কাছে শোনা– না খেতে পেয়ে অসাড়, রোগজর্জর কঙ্কালসার মানুষের কান্না তার কান দুটোকে ঝালাপালা করতে থাকে। অস্বস্তি হয়, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হাঁপানির ব্যারাম তার ছিলনা, সে রোগে মনে হয় তাকে ধরেছে। কাশতে কাশতে আর হাঁপাতে হাঁপাতে বাঁশের খুঁটিটা শক্ত করে ধরে। গাছের পাতাগুলো স্থির হয়ে একটা গম্ভীর ভাব ধারণ করে। যেন তার দিকে চেয়ে আছে– রোদ ওঠেনি–

গুমোট ভাব... রহমানের বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে।

ঠোঙায় মুড়ি চিবোতে থাকা রহমানের দশ বছরের ছেলে ওমরকে ডাক দেয়।

পরনের লাল প্যান্টটা ক্রমশ কালো হয়ে এসেছে, প্যান্টের ফিতে ঢোলা, বারে বারে ডান হাতটা দিয়ে উপরে তুলতে থাকে, মাঝে মাঝে মুখে মুড়িও দেয়। পাঁজরের হাড়গুলো স্পষ্ট গোনা যায়। ফর্সা গায়ের রঙ এ মলিন ভাব এসেছে, চুলগুলো পরিপাটি করে আচড়ানো আছে, তবু ধুলোয় যে চিটচিটে অবস্থা পলক ফেললেই চোখে পড়ে। সকালে যে কিছু খাওয়া হয়নি, একথাটা রহমান ভুলেই গেছিলো। ওমরের হাতে মুড়ি দেখে মনে পড়ে। ক্ষিদে নিমেষেই উধাও হয়। কাজ না থাকার অসহায়তা ক্ষিদের যন্ত্রণাকে মাঝে মাঝেই অতিক্রম করে যায়। ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রহমান ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

গতরাত্রে ঝড়ের আগেও গুম হয়েছিল আকাশ-বাতাস। রাত তখন নটা। কোন সকালের রেশনের চাল সেদ্ধকরা ভাত পানি দিয়ে রাখা ছিল। ক্ষিদেই পেট জ্বালা করে। পাশের বাড়ির শুকতারাদের বেড়ার ফাঁক দিয়ে এধারে বেরিয়ে আসা কচুর শাকগুলো ওমরের মা রেশমা নুন দিয়ে সেদ্ধ করে রেখেছিল, কোনও রকম খেয়ে তারা শুয়ে পড়ে।

সরকারি হুকুমে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। মুদির দোকান হলেও হত। সর্বনিম্ন পুঁজি আর ন্যূনতম আয়ের তীব্র বাসনায় খোলা চায়ের দোকান সারাক্ষণ ভ্রুকুটি করে। কোনওরকম একটু আলু ভাত-রুটি খেয়ে এ যাত্রায় বেঁচে ফিরতে হবে, চায়ের কোনো প্রয়োজন নেই।

শুকতারাদের তিনতলা বাড়ির পেছন থেকে বাড়ির সমান, ৫০ মিটার চওড়া আম কাঁঠালের বাগানটা চলে গেছে লম্বা হয়ে অনেক দূর। তারই শেষে প্রায় বর্গাকার বিঘাখানেক জমিতে পটল, বেগুন, ডাঁটা, ঝিঙে, লালিম, লঙ্কা থেকে শুরু করে কত কী! চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আগে কতদিন রুস্তমের বেঁটেখাটো বউটা শাড়ির কোঁচায়, কখনো ঘাসের ঝুড়িতে এটা সেটা ভরে নিয়েছে, লতিকার মা ছাগলের খুঁটোটা আলগা করে পুঁতে আনমনে ঘাস কাটতে কাটতে ছাগলকে বেগুনের গাছগুলো নির্দ্বিধায় খাইয়ে দিয়েছে। সে অবশ্য কিছু চুরি করেনা... তার বাড়ির লাছেই সব্জির বাহার- পুঁই, সজনে, ডাঁটা ইত্যাদি। তবু শুকতারার মায়ের রংবেরঙের শাড়ি পরে, কানের দুল হিলিয়ে কথা বলা শুনে তার গা-পিত্তি জ্বালা করে... কিছু গাছ অবোলা ছাগলে মুড়োলে তার মনটা একটু ফুরফুরে হয়।

এখন অবশ্য তেমনটা করার আর জো নেই। শুকতারার কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ভাই সাইদ বাড়িতেই আছে। সে প্রায় সারাক্ষণই বাগানে বসে থাকে। সকলের বিশেষ করে মেয়েদের চলাফেরা আর শাড়িপরার ভাবভঙ্গি বিশেষভাবে লক্ষ্য করে। প্রতিদিনের মত সেদিন বিকেলেও রেশমা, তার ছোট্ট ছাগলটার জন্য লতিকার মাদের দলেই ছিল। রেশমার ঘাসের ঝুড়িতে পা লাগতেই রুস্তমের বউয়ের মোটাসোটা শরীরখানা ধপাস করে গেল পড়ে। দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে তার, পুরুষালি ভঙ্গিমায় বলে,- কী ভাবছিস লা? এত সরু আলের উপর কি এভাবে ঝুড়ি রাখে? হটিয়ে রাখ। এটা সেটা একটু নেনা তুলে, ও ছোঁড়া তোকে কিছু বুলবেনা।

পাতলা ছিপছিপে গড়ন রেশমার। ছোট্ট মুখটা আরও শুকনো হয়ে আসে, যেন কথা বেরোয়না। মুখে শান্ত ভাব এনে কঠিন স্বরে বলে- মাসি, মুখ সামলে কথা কও। রেশমার চোখ দেখে রুস্তমের বউ ভয় পেয়েও বুঝতে দেয়না, নির্লজ্জের মত আড়ালে হাসে। রেশমা এটা সেটা নিতে পারেনা, বিকেলের ঘাস করা সঙ্গীর দল মাঝে মাঝে তাকে বোকা বলে ঠোঁট টিপে মুচকি হাসলেও বাক্যবাণ নিক্ষেপ করার সাহস জোটাতে পারেনা।

রহমান ছেলের সাথে বাড়ি ফেরে। এদিন দুপুরবেলা নুন দিয়ে ভাত মাখতেই ক্ষণিকে গলে গিয়ে জলের গাঢ়ত্ব অনেকগুণ বেড়ে যায়। কাঁচা লঙ্কা চাইতে রেশমা দৌড়ে ঘর থেকে একটা শুকনো লঙ্কা এনে দেয়- না তাকিয়ে রহমান, রেশমার হাত থেকে লঙ্কাটি ছিনিয়ে নিয়ে গোগ্রাসে ভাত গিলতে থাকে, দুবারেই লঙ্কাটা শেষ হয়। রেশমা খুব নরম গলায় বলে কাঁচা লঙ্কা শুকিয়ে গেছে তাই। রহমান সে কথায় না গিয়ে বলে, একটু পেঁয়াজ আছে, ওমরের মা? রেশমা ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে মিছামিছি পাটকাঠির ভাঙা খসা

ঝাপের রান্নাঘরে এটা ওটা তাড়াতাড়ি করে হাতড়াতে থাকে। দু তিন মিনিট পরে বলে, ছোট্ট পেঁয়াজ হলেই তো হবে, না? এই বলে সে আবার হাতড়ায়। রহমান বলে–না, আর লাগবেনা, হয়ে গেছে।

–আচ্ছা, তবে থাক। একটু আস্তে আস্তেও খেতে পারো না। পরে খুঁজে রাখবো।

পরের দিন সকাল থেকে রেশমা গ্রামের স্কুল থেকে অনেককেই ত্রাণের প্যাকেট ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখে। রুস্তমের বউ পাঁচ কেজি চাল, চার কেজি আলু এক কেজি ডালের প্যাকেট নিয়ে রেশমার সামনে দিয়ে গটগট করে চলে যায়, যেন সে রেশমাকে চেনেইনা। রুস্তম শয্যাশায়ী। কী যে রোগ তার, কে জানে। জল ছাড়া কিছুই খায় না। মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গেছে। রেশমার দেওর বাইরে আটকে গেছে, ঘরে তারও বারো বছরের ছেলে। সেও ত্রাণ পেলো। আরো কতজন আসে যায়। কদিন আগেও সিপিএম এর ছেলেরা তাকে তৃণমূল ভেবে হয়তো তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। তৃণমূলের প্রধান সিপিএম বলে হয়তো তাকে ত্রাণ দেওয়ার কথা মনে করেনি। অন্য ছেলে ছোকরারা, ত্রাণ বিলি করতে এসে, ‘বাড়িতে মরদ আছে ঠিক জুটিয়ে নেবে,’ বলে হয়তো মনে করেও, দেবার দরকার নেই ভেবে এড়িয়ে গেছে। ‘আমরা কেন পেলাম না, তারা কেন পেল, ওরা তো দু বার, ওরা তো চার বার পেয়েছে,’- এসব বার্তা নিয়ে কেউ কেউ গিয়ে জোর করে, কেউ কান্নাকাটি করেও নিতে পারলো। রেশমা পারলো না। সে বারান্দায় খুঁটিতে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে থাকল নির্বিকার হয়ে। চোখ দিয়ে জল পড়েনা, শাড়ির ময়লা আঁচলখানা দু হাতের আঙুল দিয়ে ছোট ছোট ভাঁজ করে আবার ভেঙে দেয়। রেশমার মনের জোরের সাথে শরীরের জোরও ঢেরখানি কমে আসে।

.... বর্তমান আর ভবিষ্যতেও না খেতে পেয়ে রোগাক্লিষ্ট হয়ে মৃত্যুর হাতছানিতে ধিক ধিক করে এগিয়ে যাওয়ার নির্মম অদৃষ্টের সামনে ছেলে-স্বামীর শীর্ণ মুখ দুটো ভেসে ওঠে। ছেলেকে বলে বাপের সাথে খেয়েছে, বাপকে বলে ছেলের সাথে খেয়েছে।

দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়েছে। চাল-ডালের প্যাকেট যাওয়া - আসা কখন বদ্ধ হয়েছে– দু তিন দিনের ভেজানো ভাতের কিছুটা বাটিতে পড়ে আছে, তা থেকে উঠে আসা মদের মত গন্ধ তাকে অবশ করে দেয়, নেতিয়ে পড়ে মেঝেতে।

দোতলার জানালা দিয়ে সাইদ খাপছাড়া অদ্ভূত দৃষ্টিতে নীচের ভূলুণ্ঠিত নিথর দেহটাকে নিরীক্ষণ করতে থাকে। রহমান বাড়ির রাস্তায় পৌঁছে এদৃশ্য দেখে হতবাক। সজল চোখে হতবুদ্ধির ন্যায় রেশমার শীর্ণ হাতদুটি ধরে কোলে ওঠানোর চেষ্টা করতেই সাইদকে দেখতে পায়, রাগে ভয়ে দুশ্চিন্তায় কাঁপতে থাকে। সাইদ ঝপ করে জানালার পাল্লা বন্ধ করে। রহমান কোনওক্রমে রেশমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শোওয়ায়।

ওমর তখনও বাড়ি ফেরেনি। যুদ্ধ নয়, বোমার ভয় নয়, কোনও এক অদৃশ্য রোগের ভয়ে ওমরের বাইরে যাওয়ার কড়াকড়ি আছে। রহমান ছিলনা। ঘরে আলু ডাল ফুরিয়ে এসেছে, তেল নেই, কোন উপায়ে সে কী করবে? রহমানকেই বা কী বলবে– পাড়ার ডাক্তার বলেছে তাকে বেশি চিন্তায় ফেলা যাবেনা। গ্রামের তার থেকেও ভালো পরিবারে যখন ন্যূনতম খাবারের সুরাহা হচ্ছে তখন তাকে কি ঠকানো হচ্ছে না?– তার এমনই হবার— এসব সাত পাঁচ ভাবনার মাঝে ছেলের আবদার– ‘মা আজ আলুর ঝোল কর, খালি আলুসেদ্ধ দিয়ে ভাত আমি কিছুতেই খাবোনা।’ নিজেকে সামলাতে না পেরে দিয়েছিল সপাটে এক চড় কষে। এসবে ওমর আজকাল অভ্যস্ত। ঠোঙায় চালভাজা নিয়ে সেই দুপুরে বেরিয়েছে। বাগানে গুলিডাণ্ডা, গুলতি ছোড়া খেলা চলছে— আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়। সন্ধ্যা ছাড়া আজ  সে নিশ্চয় আসবেনা রেশমা জানে। রহমান আবার একটু বাইরে বেরিয়েছে।

একটু ধাতস্থ হয়ে, হাতমুখ ধুয়ে বাইরে উনুনে চাল ফোটাতে দিয়ে রেশমা আবার বাইরে বসে। গরমটা বেজায় বেড়েছে। ভেজামাটি থেকে গরম ভাপ উঠছে।

লাল বাল্বের চারধারে উই পোকার লাফালাফি– তাদের মৃত্যুর সময় আগত। এদের দেখেও অসহায় নারীর ঈর্ষা হয়।

স্বামী ছেলের টানে বুকে দমক লাগে।

রুস্তমের বউ ব্যাগভর্তি সব্জি নিয়ে যাবার সময় রেশমা চোখ তুলে তাকাতেই, হাসিমুখে বলে– করলা, পেঁয়াজ, একটু কাঁচালঙ্কা, শশা, এইসব আর কি।  আরো ভেতরে ঈর্ষার দপদপানি বেড়ে ওঠে রেশমা টের পায়, হাত-পা জোরে জোরে খসখস করে চুলকোতে থাকে। ওমর চুপি চুপি রান্নাঘরে খসে পড়া ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে দেওয়াল ঘেষে ঘরে ঢোকে।

কিছুক্ষণ পরে রহমান  আসে। হাতে ছোট্ট ফলের ক্যারি। রহমান বলে– হাটে গেছিলাম। এটুকু ক্যারিতে এক কেজি আলুর সমান জিনিস কোনওরকমে ধরে– রেশমা আন্দাজ করে। রহমান বলে– ওমরের জন্য দুটো পাকা আম আছে, একটু সব্জি আছে। রেশমা রাগে গজগজ করে ওঠে— রুস্তমের বউ এর যে ক্ষমতা তা ব্যাটাছেলে হয়ে তোমার নেই। রহমান স্থির দৃষ্টিতে দূরে আলো আঁধারে তাকিয়ে কোনো তল খুঁজে পায়না। শ্লথ পায়ে ঘরে ঢোকে। রেশমা কুঁকিয়ে কেঁদে ওঠে।

সারাদিনের অনবরত দৌড়ঝাপ শেষে আলুসেদ্ধ ভাত খেয়ে ওমর গভীর ঘুমে শুয়ে আছে। দুশ্চিন্তা, শোক, অসহায়ত্ব কোনও কিছুর ছাপ তার মুখে নেই। বাইরের পৃথিবীকে সে আজও দুহাতে উপভোগ করে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রহমানের চোখে জল আসে, গোপনে মুছে নেয়। কিছুক্ষণ পর রেশমা রহমানের পা ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

রাত দশটা বেজে গেছে। পাশের বড় বাড়িটার ভদ্র মানুষগুলোও সারাদিন বিছানায় শুয়ে, টিভি দেখে, গান শুনে ক্লান্ত হয়ে খানিক বিরক্ত হয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। জমকালো বাড়িটাও প্রকৃতির গাঢ় অন্ধকারে কালো ছায়া হয়ে আছে। কুকুরগুলোও ডাকেনা। মারুতি, বাস রাস্তা কাঁপায়না, লরির ঝাঁকানি, ভারিক্কি গতি কবেই থেমে গেছে। গাঢ় আঁধারেও বোঝা যায়, অন্ধকার উৎকর্ণ হয়ে আছে সামনের প্রকাণ্ড বটগাছটাকে ঘিরে। রেশমার আজকাল আর একলাও বাইরে বেরোতে ভয় করেনা। আকাশে আজও তারারা নেই, বৃষ্টি হবে বলেও মনে হয়না। রহমান আর রেশমা পাশাপাশি বসে আছে। রেশমা হাত বাড়িয়ে রহমানের ডান হাতটা ধরে, রহমান সেই হাত শক্ত করে ধরে দুহাত দিয়ে।

পরের সকাল। যে করেই হোক টাকা ইনকামের কিছু উপায় খুঁজতেই হবে। মনে ভরসা আর জোর নিয়ে রহমান রাস্তায় বের হয়– সে মনিস খাটতে পারে, ইচ্ছে করলেই উপায় হয়। তৎক্ষণাৎ হাতিমপুরের বাসটা মোড়ে এসে থামে। বাসটা অনেকদিন আসেনি। সেখানে কত ধরনের কারখানা– পাটকল, রাইসমিল...। সে পা চালিয়ে হাঁটে। মনে হয় লোকজন সব ঠিক করাই ছিল। হুস করে বাসটা রহমানের ক্ষীণ আশাকে নিভিয়ে দিয়ে জোর গতিতে দূরে মিলিয়ে যায়।

 

:: ভয়েস মার্ক ::

- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -

সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন

গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১

পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক

নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার

সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ

RNI Ref. Number: 1343240

-: যোগাযোগ :-

সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮

azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com

:: সামাজিক মাধ্যম ::