ষষ্ঠ বর্ষ। প্রথম সংখ্যা জানুয়ারি - মার্চ ২০২৪

প্রবন্ধ

ভাষা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধি

আযাদ রহমান

ভাষা অনুভূতির প্রকাশক। অনুভব যত তীক্ষ্ণ যত তীব্র যত গভীর ভাষার ব্যঞ্জনা তত সমৃদ্ধ। ভাষার সমৃদ্ধি তাই সেই জাতির উন্নততর যার অনুভূতি চর্চা সূক্ষতর।

উদাহরণ-১। ভারতীয় জীবন ধারা

বৈদিক আর্য জীবন চর্চা সঞ্জাত ভাষা। এই জীবন চর্চার গোড়াতে সন্ধানী দৃষ্টি ফেললে দেখা যাবে পূর্বেকার নগর সভ্যতার শোষণ যন্ত্রণার বিরুদ্ধে কৃষিভিত্তিক উৎপাদকের সংগ্রাম। যাতে দস্যু অর্থাৎ লুঠেরা পরাজিত হয়। গড়ে উঠে সেই সাহিত্য ব্যঞ্জনা যা চিরায়ত মর্যাদার অধিকারী। পুরাণ, বেদ, উপনিষদ আর মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত।

এই চিরায়ত তত্ত্ব কাহিনী ও তত্ত্বসিদ্ধান্ত সমূহ পরবর্তী জেনারেশন এর অনুভূতি চর্চা অর্থাৎ জীবনচর্চাহীনতায় অসার, অলৌকিক পুরনো যুগের গল্প-কাহিনিতে অবনমিত হয়। সমকালীন ক্ষমতা-চক্র তাতে রক্ষণকামী প্রক্ষেপণ ঘটিয়ে তাকে আরো জঞ্জাল করে তোলে। একই সঙ্গে ভাষার সেই অর্জিত সমৃদ্ধি ক্ষয় পেতে পেতে বর্তমান সময়ে এসে তা মৃত ভাষায় রূপ নিয়েছে।

নানান গল্প-কেচ্ছার জঞ্জাল সরিয়ে ভারতীয় জীবন বোধের নির্যাস সেই সাহিত্য থেকে আহরণ করতে হলে প্রয়োজন অনুভূতির সূক্ষ্মতর গভীরতর অনুশীলন। যা আর্থসমাজ সংস্কৃতি তথা রাজনৈতিক স্পন্দনহীন শ্যাওলায় মজে থেকে সম্ভব নয়।

সমকালীন আর্থসামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় শ্রম-মূল্য ভিত্তিক জীবন জিজ্ঞাসা থেকেই সেই অনভূতির চর্চা হয়। যা আখেরে আর্থসমাজ সস্কৃতির মান বাড়ায়। আর তার প্রকাশক ভাষাও তত সমৃদ্ধ হয়। অন্যথায়, সমকাল রক্ষণকামী ক্ষমতা চক্র উল্লিখিত জ্ঞান-দর্শন প্রজ্ঞার সংকলনকে ঐতিহ্যের অনড় স্তূপের সেন্টিমেন্ট হিসেবে সংক্রমণ করে। ব্যাক টু হিসটোরিক্যাল পাস্ট এর স্লোগান দেয়। যার ফেরে পড়ে গণমানস জ্ঞান-প্রজ্ঞার সংকলিত নির্যাস দূরের কথা সমকাল জীবন যন্ত্রণার কারণ অনুধাবন করতেও পারেনা। বাজিমাৎ করে রক্ষ।

আর কী করে? আর্থসমাজ সংস্কৃতিকে পাঁকে নামায়। সন্ত্রাস করে। যা ভাষা সন্ত্রাস রূপেও আসে। যেমন সম্প্রতি 'এক দেশ এক ভাষা এক ধর্ম' স্লোগান। যা কোনো একটি জনপদের আর্থসমাজ সংস্কৃতির সমৃদ্ধির প্রধান উপাদান ভাষাকে সংকুচিত করে। এহেন সন্ত্রাসের আবহে নাগরিক 'অস্তিত্ব' বর্ণিত তার ভাষা-সংস্কৃতি রূপ বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলতে দেবে নাকি তা শক্তিশালী করার আন্তসংগ্রাম শুরু করবে তার উপর নির্ভর করে তার জীবনের মান।

উদাহরণ-২। ইসলাম

ভারতীয় জীবন ধারায় যে অনুভূতি চর্চা সমৃদ্ধ ভাষা সংস্কৃতির সৃজন করেছিল, বস্তু বিকাশের সেই একই ধারায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রকৃতি জিজ্ঞাসার পূর্বতন নিদর্শন সহ সেই অনুভূতি চর্চা খন্ড-বিখন্ড গোষ্ঠী জীবনের দুরাচার আর শোষণী শ্রম-সম্পর্ককে অস্বীকার করে আর্থসামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল রাসুলুল্লাহর নেতৃত্বে। আলকোরানিক জ্ঞান-বিশ্বাস-সংগ্রাম তত্ত্ব যে শান্তি প্রতিষ্টার ভিত। সেই ভিত অর্জন সেই অনুভূতি চর্চার সূক্ষ্মতম গভীরতম স্থান স্পর্শ করেই সম্পন্ন হয়েছিল। যার পরিণতিতে অতি সমৃদ্ধ ও সাহিত্য ব্যঞ্জনা যুক্ত আরবি ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত আলি পরবর্তী রক্ষণকামী ক্ষমতা চক্র আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক সেই জীবন চর্চাকে ব্যাহত করার ভয়ঙ্কর চক্রান্ত করে। যাতে বস্তু অর্থাৎ সত্য অর্থাৎ অনুভূতির সেই চর্চা বন্ধ করে আর্থসমাজকে বেঁধে ফেলা যায় অনড় অচল এক অচলায়তনে। রীতি আর সংস্কার যেমন ভারতীয় জীবনবোধকে পর্যুদস্ত করেছিল, ঠিক

তেমনি বিকাশ বিরোধী রীতি-সংস্কারের জঞ্জাল বুনে আর্থসমাজ সংস্কৃতির পজিটিভ প্রবাহকে দূষিত করে ফেলা হল। গণমানস এমন এক ভেলকিতে দিশাহারা হয়ে গেল যা থেকে আজও তার মুক্তি ঘটেনি। পরিণামে প্রথম দিকের সাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শনের পথিকৃৎ সভ্যতা ক্রমে জড়ভোগের এক জঞ্জালে রূপ নিয়েছে। ভাষা-সংস্কৃতি তার হয়ে গেছে অনড় অচল জীবন বিরোধী মৃতপ্রায়।

এই মৃতপ্রায় জীবন থেকে বেরোতে গেলে তাই দরকার সত্তামন্থনী জীবন জিজ্ঞাসার চর্চা। সেখান থেকেই আলকোরানিক জ্ঞান-দর্শনের মূল্য আবিষ্কৃত হতে পারে। আর তা হলেই  দেখা যাবে আর্থসমাজ সংস্কৃতির সমৃদ্ধ রূপ।

উদাহরণ-৩। কম্যুনিজম

ভারতীয় দর্শনের আর্থসামাজিক প্রয়োগহীনতা আর আলকোরানিক দর্শনের প্রায়োগিক বস্তুবিচ্যুতি পৃথিবীতে জীবন দর্শন শূণ্যতা সংক্রামিত করে। জাকাত তত্ত্ব প্রয়োগ বন্ধ হয়ে যায়। সেখান থেকেই সেই একই বস্তু জিজ্ঞাসার পরিণতিতেই মার্কসীয় দর্শন উদবৃত্ত মূল্য তত্ত্ব নিয়ে উঠে আসে। যা আর এক সমৃদ্ধ ভাষা-সংস্কৃতির প্রাঞ্জল প্রবাহের নিদর্শন। এই দর্শনের প্রয়োগ কেন্দ্রিক যে সোভিয়েত তত্ত্ব তাও সেই ভাষা ও সংস্কৃতিকে উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত করে। সোভিয়েত ভাষা সংস্কৃতি পৃথিবীর গবেষণার বিষয় হয়। জার সাম্রাজ্যের অচলায়তন ভেঙেই যার উত্থান।

কিন্তু অর্থনৈতিক নিয়তিবাদে মার্ক্সবাদকে অধঃপতিত করেই রক্ষণকামিতা সোভিয়েতকে পরাজিত করার চক্রান্ত করে। সফল হয় গত শতকের নয়ের দশকে। ইউরোপ সহ গোটা পৃথিবী পড়ে যায় রক্ষণকামের নয়া রূপ পোস্ট মডার্ন খপ্পরে। যেখান থেকে উঠে আসে পোস্ট ট্রুথ, অ্যান্টি লোগোস, অ্যান্টি সেন্টার, বিনির্মান ইত্যাদি শব্দবন্ধ। আর রয়ে যায় ইতিহাসের অতীত যার শবদেহ ধারণ করে দেশে দেশে কম্যুনিজমের তথাকথিত উত্তরাধিকারীরা। যা আরেকটি ধর্মের রূপ নিয়েছে। মার্কসীয় আরোহ মূলক তর্কপদ্ধতি এদের হাতে অতিবোদ্ধার অহঙ্কারে পর্যবসিত হয়। এরা নিজেরা হয় বস্তুবিচ্ছিন্ন আর আর্থসমাজকেও দিতে পারেনা কোনো উন্নত সমাজ সংস্কৃতি। কিন্তু আর্থসমাজকে জ্বালাতন করতেও ছাড়ে না।

এই উৎকেন্দ্রিকতা থেকে বের হতে গেলেও দরকার সমকাল আর্থসমাজ সংকট নিরিখে জীবন জিজ্ঞাসার। যা থেকেই শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব নাকি আমিত্ব সংগ্রাম তত্ত্ব কোনটা সমকাল জীবন মুক্তির অগ্রদূত তাও পরিষ্কার হয়। আর্থসমাজ পেতে পারে উন্নততর আর্থসমাজ সংস্কৃতি। অর্থাৎ ভাষা-সংস্কৃতি।

কেবল ভাষা নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে কথা বললে আর অনুষ্ঠান করলে ভাষা তথা সংস্কৃতির উন্নতি হয় না। ভাষা সংস্কৃতির উন্নতি হয় সামগ্রিক আর্থসামাজিক জীবনের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, শত্রু-মিত্র নির্ণয়, সংগ্রামী নীতি ও কৌশল নির্বাচন ও তার ভিত্তি রূপী তত্ত্ব অনুশীলনের মাধ্যমে। এক কথায় জ্ঞান-বিশ্বাস-সংগ্রাম এর ত্রিশূল তত্ত্ব আর্থসামাজিক অনুশীলনে এনেই তা করতে হয়। যার সূচক বিন্দু শ্রম-মূল্যের হিসেব কষা আর অর্থনীতির অন্ধকারকে আলোয় আনার সাংস্কৃতিক চাষবাস।।

 

:: ভয়েস মার্ক ::

- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -

সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন

গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১

পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক

নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার

সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ

RNI Ref. Number: 1343240

-: যোগাযোগ :-

সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮

azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com

:: সামাজিক মাধ্যম ::