ষষ্ঠ বর্ষ। প্রথম সংখ্যা জানুয়ারি - মার্চ ২০২৪

গল্প

বিকেলের সূর্য

আব্দুল মোমিন

বিকেলবেলা তবুও সূর্যের তাপ কমছে না। সঙ্গে প্রচণ্ড গরম। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। অলস এবং সবসময় চিন্তা করা সাইনুলকে তার বন্ধু  ডেকে  নিয়ে যায়, অসুস্থ মাস্টারকে  দেখতে।  এক প্রকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাইনুল যায়। মাস্টারদা.... বলে বন্ধুটি  খাটে বসে।  ডান পা খাটে  তুলে হাঁটু মুড়ে, বাম পা খাটের পাশে ঝুলিয়ে বসে শুয়ে  থাকা  অসুস্থ মাস্টারের ডান হাতটি ধরে টিপছে। সাইনুল মাস্টারের মাথার দিকে দাড়িয়ে থাকে এবং বিব্রত ভাব নিয়ে সারা ঘরটিকে দেখতে থাকে। তাই দেখে বন্ধু বলে- চেয়ারে বস না, দাড়িয়ে আছিস কেন? বাম পাশের  তিনটি নকশা করা কাঠের চেয়ারের একটিতে বসে। বসে থেকে চারিদিক দেখছে আর ভাবছে- এত সুন্দর ঘর আসবাবপত্র আর সব  অগোছালো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু তেমন খারাপ তার লাগছে না।

পশ্চিমদিক দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেই বড় একটা ডাইনিং, সিড়ির পাশেই একটি রুম, ডাইনিংয়ের ওপারে অর্থাৎ পূর্বদিকে কিচেন এবং বাথরুম। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে আছে  গ্রিল আর কাচের স্লাইডিং ডালা। দক্ষিণ দিকের সাইডের সব ডালাগুলি খোলা আছে। বাইরে থেকে সূর্যের তাপ আসছে। যার ফলে ডাইনিং টি খুব গরম আছে।

হঠাৎ ডালা টানার শব্দে তার সম্বিত ফেরে। তাকিয়ে দেখে একটি মেয়ে উত্তর দিকের গ্রিলের কাচের  ডালাগুলি খুলে দিচ্ছে। সূর্য উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে অনেকটাই সরে গিয়েছে। তাই  সূর্যের তাপ আর গ্রিল দিয়ে আসছে না। গ্রিলগুলি খুলে দেওয়ায় ডাইনিংয়ে ঘুমোটভাব কয়েক মিনিটের মধ্যে কমে গেলো। ধীরে ধীরে বাতাস বইছে অনুভুত হচ্ছে। মেয়েটি ডাইনিংয়ে কাজ করছে দেখে, মেয়েটির থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে  মাস্টার আর তার বন্ধু কী করছে আর কী  বলছে  তাই শুনতে লাগলো।

মেয়েটির হাত থেকে মাঝে মাঝে হাতের বালার  ঝন ঝন আওয়াজ আসছে। তাতে কথোপকথন শোনার ক্ষেত্রে সাইনুলের মনোযোগ নষ্ট করছে। মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে। কাজেই তাদের কথোপকথনে  আরও বেশি করে মনোযোগ দিচ্ছে।

মিনিট 10 পর মেয়েটি  মাস্টারের মাথার কাছে এসে হঠাৎ করে বলে- এই পেপারটি কী আপনার পড়া হয়ে গেছে? এটা কি সরিয়ে রাখবো?

মেয়েটির নম্র ও ভদ্র নরম কণ্ঠে কথা শুনে সাইনুলের বিরক্তি সরে গেলো এবং মেয়েটিকে দেখার তার বাসনা কাজ করছে। বাসনা নিয়েই চারিদিকে  চেয়ে দেখলো। দেখেই তার অলসতা যেন কেটে গেলো। চমৎকারের মত ঘরের আসবাবপত্র থেকে পোশাক জিনিসপত্র,  এমনকি পায়ের খুলে রাখা চটি জুতো সবই  পরিপটিভাবে সাজিয়ে রাখা।

রুমের বাইরে ডাইনিংয়ে একটি প্লাস্টিকের লাল রঙের টেবিল আর একটি কাঠের চেয়ার আছে।  টেবিলে রাখা আছে- জল ভর্তি মাজার ও স্প্রাইটের দুটি বড়ো বোতল, অর্ধেক জল ভর্তি একটি গ্লাস প্লেট দিয়ে ঢাকা,  ছড়ানো বেদনার দানা ভর্তি একটি প্লেট নেট ও প্লাস্টিকের তৈরি ঢাকনা দিয়ে  ঢাকা আছে।

সবদিকে চেয়ে তার মন যেন বিষাদে ভরে গেলো! নির্বিকার ও অবসাদে ভরা চোখ দুটি ছোট করে ভাবতে শুরু করলো- ঘরে দরজা খুলতেই মূত্রের আর একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগে। আজও তার অন্যথা হয়নি। রাতে বাচ্চা মেয়েটির প্রস্রাবে ভেজা পোশাকগুলো সোফা থেকে নিয়ে বাইরে রেখে আসে এবং পরিষ্কার পোশাকগুলো পাশে সরিয়ে ফ্যানের সুইচটি অন করে হেলানা দিয়ে আরাম করে বসলো। আব্বা আব্বা করতে করতে বাচ্চা মেয়েটি দু পায়ের ফাঁকে ঢুকে কোমর জড়িয়ে ধরে।

সাইনুল মেয়েটিকে ভীষণ ভালোবাসে। ভালোবেসে মেয়েটির নাম ঊষা রাখে। ঊষাও ভীষণ বাবা ঘেঁষা। কঙ্কাল সার ঊষাকে কোলে তুলে নেয়। ঊষার বয়স আড়ায় বছর । মাত্র কয়েকটি শব্দ বলতে পরে।  ভাত খাব, বিস্কুট খাব স্পষ্ট বলতে পারে। সাইনুল গালে একটু চুম্মা দিয়ে জিজ্ঞেসা করে, ঊষা মামনি তুমি ভাত খাবে? দুদু খাবে? তোমার ভীষণ খিদে পেয়েছে? মেয়েটিও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দেয়। বেলা সাড়ে দশটা। সাইনুলেরও ভীষণ খিদে পেয়েছে। সাইনুল কোমল স্বরে বলে, ওগো শুনছো! উষা মামনির ভীষণ খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দাও।

বাড়ির সদর দরজায় বসে সাইনুলের স্ত্রী বলে উঠলো- আর কি খাবে ও! সকালে মমতানিকে দিয়ে চায়ের দোকান থেকে কেক আনিয়েছি। সেটা পুরোটাই খেয়েছে। আবার কিসের খিদে!

বগলে হাত দিয়ে তুলে  ধরতেই উষা কচি দুটি হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। সাইনুলও নিঃশব্দ বুকে মিনিট তিনেক জড়িয়ে ধরে থাকে। স্ত্রী আসছে না দেখে, উষাকে খাটের ওপর বসিয়ে সাইনুল বলে, তুমি একটু বসো আমি খাবার নিয়ে আসছি। মুখহীন প্লাস্টিকের জগ নিয়ে সাইনুল তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে, তুমি খেয়ে নিয়েছ?

উচ্চ স্বরে আর রূঢ় ভাবে বলে- হ্যাঁ, আমি খেয়ে নিয়েছি।

অভ্যস্ত সাইনুল এক হাতে জল ভর্তি জগ আর অন্য হাতে সবজি ও ভাতের থালা নিয়ে আসে। জগটি  আগে বিছানায় রেখে বিছানার উপর একটি কাপড় বিছিয়ে খাবার থালা রাখে। তারপর খালি থালা নিয়ে এসে জল দিয়ে বাচ্চাটির হাত ধুইয়ে দেয়। ঘর অন্ধকার হচ্ছে দেখে লাগানো জানলাগুলো খুলে। জানলাগুলো খুলে এসে দেখে ঊষা ভাতের বড় দলাটি হাতের মুঠো নিয়ে খেতে শুরু করে দিয়েছে। তাই দেখে সাইনুলের মন একেবারে শুকিয়ে যায়, কথা বলার শক্তিও হারিয়ে যায়। খুব আস্তে করে বিছানায় বসে। ভাত - আলু - বেগুনে মেখে চার-পাঁচ কাঁড়া আগে ঊষাকে খাওয়ায়। তারপর নিজেও খেতে শুরু করে। খাবার  শেষে থালা ও জগ বাইরে রেখে এসে,  বিছানা থেকে  গছিয়ে রাখা পোশাকগুলো সরিয়ে রেখে, বিছানা ঝেড়ে মেয়ে বাবা শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ল। সাইনুলেরও চোখ দু জড়িয়ে আসছে।

আপনার পেপারটি কি পড়া হয়ে গেছে? (টেবিলের আনন্দবাজার পেপারটি দেখিয়ে) আমি সরিয়ে রাখবো?

প্রশ্নে সইনুলের ভ্রম ভাঙে আর অতি আগ্রহ নিয়ে মেয়েটিকে দেখে, বয়স 30 বছর। দারিদ্র্য ও অসুস্থতার প্রকটতর ছাপ তার শরীরে রয়েছে।

মুখের চয়াল ডুকে গেছে। যেন চোয়ালে চোয়াল শক্ত করে এঁটে আছে। কনুই ও কব্জির হাড় টিউমারের মতো ফুলে আছে। হালকা হলুদের ওপর সবুজ পাতা ছাপা ঢিলেঢালা নাইটি পরে আছে আর গলায় একটি লাল জলজলে ওড়না।

মেয়েটি  সারাক্ষণ কিছু না কিছু কাজ করেই চলেছে। সাথে সাথে রান্নাও করছে। তার দু হাতেই দুটি করে চুড়ি আছে। সারা ঘরে সেই চুড়িগুলির ঝন ঝন শব্দ হচ্ছে। কাজ করার সুক্ষতা, নম্রভাবে চলা আর চুড়ির সেই ঝন ঝন  শব্দ ডাইনিংয়ের মধ্যে যেন মনোরম সুর  তৈরি করছে। যেন কথোপকথনের মাঝে ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড। কেও তাতে বিরক্ত হচ্ছে না।

কোনো কারণে সেই শব্দ না আসলে  বরং মন সেই শব্দ শোনার অপেক্ষা করছে।

এই সব ভেবে সাইনুলের বিরক্তিভাব আর ঘুমাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেছে,  আর ঘন ঘন হাই তুলছে না। তার মধ্যে একটা ফ্রেশ ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব কিছুতেই অতি আগ্রহপূর্ন ভাব।

কিছুক্ষণ পর ওড়নায় মুখ মুছতে মুছতে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সুনয়না। হাতের চুড়িগুলো ওপরে তুলে হাতের সাথে টাইট করে  ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি সালোয়ার কামিজ নিয়ে বাথরুমে যায়। সালোয়ার কামিজ পড়ে বেরিয়ে আসে। এত গরমে সে যে কাজ করছিল তাকে দেখে কেওই বুঝতে পারবে না। চোখে মুখে এবং চলা ফেরায় কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। ঘামের কোনো বালাই নেই, এমন কি মাথার  চুলগুলো পরিপাটি ভাবেই আছে। সাইনুলের পাশের চেয়ারে  ঠিক মাঝে একটি ডিপ লাল চামড়ার রঙের ভ্যানিটি ব্যাগ রাখা আছে। দুটো জায়গায় ছিঁড়ে ফুটো হয়ে গেছে। ব্যাগটি সুনয়না খুব পছন্দের। ব্যাগের হাতুল দুটি একটি একটি করে সরিয়ে, সাইড পকেটের চেন খুলে চিরুনি, আয়না এবং সিঁদুর কৌটো বের করে। মাথা আঁচড়ে একটি কাঠিতে করে মাথার সিঁথিতে চুলের ফাঁকে ছোট করে সিঁদুরের দাগ দেয়। তারপর সবকিছু আবার আগের মতো করে যত্ন সহকারে ব্যাগের মধ্যে রেখে দেয়। খুবই মন্থর পায়ে সাইনুলের সামনে দিয়ে গিয়ে খাটের পাশে দাঁড়ায়। বলে, মাস্টার মশাই..... (সুনয়নার মাস্টার মশাই ডাক শুনেই অসুস্থ মাস্টার মশাই প্রাঞ্জল ভাবে খুব কষ্ট করে অর্ধেক ঘাড় ঘুরিয়ে  মেয়েটির দিকে তাকায়। যেন মাস্টার মশাই সেই ডাক শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। খুব ছোট বাচ্চা যখন কোমল হাতটি দিয়ে আলতো ধরে তখন যেমন অনুভূতি হয় মাস্টার মশাই ডাক শুনে মাস্টার মশাইয়ের সেইরকম অনুভূতি হয়) সুনয়নাও সেটা অনুভব করে একটু থেমে আবার বলতে  শুরু করে-- টেবিলের ওপর বেদনার দানা ছড়িয়ে রেখেছি, মুসম্বি লেবু কেটে রাখা আছে। সব ঢেকে রেখেছি। দশ মিনিট হল আপনি ঔষধ খেয়েছেন আর দশ মিনিট পর আয়ানের কাছে চেয়ে নেবেন। এখন চারটে তেরো, সাড়ে চারটেই  আর একটা ঔষুধ খাওয়ার আছে, খেয়ে নেবেন। আপনার বালিশের নিচে রাখা আছে। এই দেখুন বলে বালিশটির এক সাইড তুলে দেখিয়ে দেয়। আলু ছুটিতে আর আপনার পছন্দের বাটা মাছ  অল্প ঝোল করে রান্না করেছি। আপনি যেমনটি করে বলে দিয়েছেন সেই রকম করেই রান্না করেছি। শুধু নুন ঝাল কম করেছি। আয়ানকে বলবেন, মাছের মাথাগুলো যেন ভেঙে দেয়। আপনার কাঁসার থালাটি ভালো করে ধুয়ে রেখে দিয়েছি। আমি বাড়ি পৌঁছেই আপনাকে ফোন করবো। আয়ান কিছু দরকার হলে আমাকে ফোন করিও। মাস্টার মশাই আমি এখন বাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছি। মাস্টার মশাই মাথা নেড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সম্মতি দেয়।

হিন্দু নারী হয়েও রোদ্রের তাপে ঝলসে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য  চেয়ারের ওপর রাখা ওড়না মুখে, মাথায় ও ঘাড়ে মুসলিম বোরখা ধারি মহিলাদের মতো করে ওড়না জড়িয়ে নেয়। বেরিয়ে যাওয়ার আগে প্রতিটি জিনিস আরো একবার দেখে নেয়।

সাইনুলের যেন আকস্মিক কিছু ঘটে গেল। দেহের সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল।

 

:: ভয়েস মার্ক ::

- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -

সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন

গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১

পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক

নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার

সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ

RNI Ref. Number: 1343240

-: যোগাযোগ :-

সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮

azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com

:: সামাজিক মাধ্যম ::