শ্রীচেতনিক
১।৷
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ১০১ মিলিয়ন। এই পশ্চিমবঙ্গ স্বাধীনতার পর দু দশকেরও বেশি সময় শাসন করেছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। তিন দশকেরও বেশি শাসন করেছে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার। এবং তারপর বর্তমানে এক দশকেরও বেশি ক্ষমতায় আছে তৃণমূল কংগ্রেস।
এই তিন জমানা জুড়েই রাজনৈতিক সহিংসতা ক্রম প্রসারমান থেকেছে। থেকেছে কেন?
২৷।
গণতন্ত্রে সহিংসতাকে ব্যবহার করা হয়েছে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোবার অস্ত্র হিসেবে। রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করবার জন্য, দেশের সম্পদ কব্জা করবার জন্য এবং গণতান্ত্রিক পরিসরকে নিরঙ্কুশ নিজ দখলীভূত করবার জন্য। কিছু এমন গণতান্ত্রিক দেশ আছে যারা সহিংসতাকে রাজনৈতিকভাবে একসেপ্টেড বিষয় হিসেবে মেনে নিয়েছে। যদিও ‘গণতান্ত্রিক’ লক্ষ্য হলো সহিংসতা পরিহার করা, বলা ভালো সহযোগিতামূলক পন্থার মাধ্যমে এই সহিংসতা দূর করা।
৩।।
কিন্তু এমন একটি পরিসর কি তৈরি করা সম্ভব যেখানে রাজনৈতিক জীবনে ভায়োলেন্স দূরে রাখা সম্ভব? এটা কঠিন কাজ সন্দেহ নেই। কারণ রাষ্ট্র ভায়োলেন্সকে বৈধ বিষয় হিসেবে প্রয়োগ করে। এখন আমরা জেনে নিই রাজনৈতিক সহিংসতা কাকে বলে এবং তা এই রাষ্ট্রীয় সহিংসতা থেকে কীভাবে আলাদা?
রাজনৈতিক সহিংসতা অপরাধমূলক সহিংসতার থেকে আলাদা। অপরাধমূলক সহিংসতা ব্যক্তিগত লাভের জন্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা হল কোন একটি পলিটিক্যাল রেজিমকে বা তার পলিসিকে সহিংসভাবে চ্যালেঞ্জ করা অথবা সহিংসভাবে ডিফেন্ড করা। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সেই পলিটিক্যাল রেজিমের প্রকৃতি, যাকে চ্যালেঞ্জ অথবা ডিফেন্ড করা হয় ফিজিক্যাল আক্রমণের মাধ্যমে।
৪।।
উত্তর প্রদেশে ক্রিমিনাল মাফিয়ারা কোনো জেলার নিয়ন্ত্রণ দখলে রাখে। পলিটিশিয়ানরা তাকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে। গুজরাট, উত্তর প্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের নির্বাচনী ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভাজনকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ এবং বিহারের ক্ষেত্রে জাতপাত এবং জাতপাত জনিত সহিংসতা রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে এথনিক (Ethnic) ভায়োলেন্স, মতাদর্শগত লড়াই, ধর্মীয় আন্দোলন প্রভৃতি ঘটে থাকে। এছাড়া দেশের আরো বেশ কিছু রাজ্যে ‘মাওবাদী’ সহিংসতা দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহিংসতা এই সবগুলোর থেকে স্বতন্ত্র।
৫।।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথে সহিংসতার একটা যোগ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে এবং বজায় রাখতে সহিংসতা ব্যবহার করা হয়। অন্য রাজ্যের থেকে এটা আলাদা কারণ রাজনৈতিক আধিপত্য এবং যথেচ্চ মেরুকৃত পার্টিজানসিপ হল এর প্রকৃতি। পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের ভায়োলেন্স নিত্যদিনের।
৬।।
জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য কী বলছে?
২০২১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক খুন হয়েছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত তিন দশকে কেরালায় ২০০ এর বেশি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং ‘বামপন্থী’ সিপিএম এর মধ্যে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে কুড়িটা করে রাজনৈতিক খুন সংঘটিত হয়েছে।
রাজ্যভিত্তিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ( ২০১০ থেকে ২০১৯)
ক্রমিক নং |
রাজ্যের নাম |
মোট নিহতের সংখ্য |
১ |
পশ্চিমবঙ্গ |
১৬১ |
২ |
বিহার |
১৫৬ |
৩ |
মধ্যপ্রদেশ |
১০৭ |
৪ |
ঝাড়খণ্ড |
৮৭ |
৫ |
অন্ধ্রপ্রদেশ |
৭৪ |
৬ |
উত্তরপ্রদেশ |
৭২ |
৭ |
কেরালা |
৬৮ |
৮ |
কর্ণাটক |
৬১ |
সূত্র: জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো প্রতিবেদন- ২০১০ থেকে ২০১৯, খুনের মোটিভ রাজনৈতিক।
৭।।
প্রাক স্বাধীনতা পর্বেও বাংলায় সহিংসতা ছিল। ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তরের মাধ্যমে বিপ্লব প্রয়াস। পরবর্তীতে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ১৯৪৬, তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬-৪৭ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৬৭ সালে নকশালপন্থী বিদ্রোহ।
বামপন্থী ও কংগ্রেসিদের পরস্পরের প্রতিহিংসা প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।
১৯৭০ সালের ১৭ মার্চ পূর্ব বর্ধমানের সাইবাড়ির কংগ্রেস কর্মীদের হত্যা, ১৯৭১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসুর হত্যাকাণ্ড। ১৯৭২ সালে কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে পেশি শক্তির যথেচ্চ ব্যবহার করা হয়। সংগ্রেস সন্ত্রাস করে, গুন্ডা বাহিনী দিয়ে এবং রিগিং করে নির্বাচন জয়লাভ করে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্বে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস লাগামছাড়া হয়ে যায়।
৮।৷
সিপিএমের উত্থান এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসের প্রাতিষ্ঠানিকরণ
১৯৭৭ সালে সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। তারা পূর্বতন কংগ্রেসের জুতোতেই পা গলায়। গ্রামাঞ্চলে এই সন্ত্রাসের ধরন কংগ্রেস জমানার থেকে অনেক বেশি অর্গানাইজড ছিল। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা ক্রমশ শক্তিশালী করা হয় এবং পঞ্চায়েতে অর্থ যোগানের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়। এইভাবে পঞ্চায়েত ক্রমশ বিবদমান পার্টিগুলির কম্পিটিশনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। পঞ্চায়েতের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি তথা গ্রামের মানুষের উপর আধিপত্য কায়েম করা হয়। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই পঞ্চায়েতের ক্ষমতা কব্জা করে গ্রামীণ ক্ষেত্রের ওপর আধিপত্য জারি রাখা হয়।
ইতিমধ্যে বামফ্রন্ট সরকার অপারেশন বর্গা নামক ভূমি সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়। যাতে ভাগচাষীদের জমি রেকর্ড এর ব্যবস্থা করা হয় এবং কিছু পরিমাণ খাস জমি বন্টন করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বামেরা তাদের সমর্থনবৃত্ত শক্তিশালী করে। এতে করে গ্রামীণ মানুষের ওপর পার্টির হোল্ড বাড়তে থাকে। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ডোল মূলক কর্মসূচিগুলি পার্টির আওতায় থাকা লোকেরাই পেতো। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ সারথি ব্যানার্জীর মতে, সরকারি কর্মসূচিগুলি পার্টি প্রোগ্রামের মত ব্যবহার করা হতো এবং পার্টির সঙ্গে যুক্ত লোকেরাই তার সুবিধা পেত। পঞ্চায়েতের ফাণ্ড পার্টির সংগঠন শক্তিশালী করবার কাজে ব্যবহার করা হতো। ( Party, Power and Political Violence in West Bengal by Partha Sarathi Banerjee)।
তাঁর পর্যবেক্ষণে আরো জানা যাচ্ছে, সিপিএমের আওতায় গ্রামীণ সমাজ পার্টির সর্বময় ক্ষমতার আওতায় এসে যায়। পরিবার নয়, জাত নয়, ধর্ম নয়, বাজার নয়, কেবল পার্টি এই একটি শব্দ মানুষের জীবন নির্ধারণ করত। এটি সেই প্রতিষ্ঠান যা প্রতিটি এক্টিভিটিতে নাক গলাতো। এজন্যই ‘পার্টি সোসাইটি’ শব্দটি আর্থসমাজের পুরোপুরি রাজনীতি করনের বিষয়টি বোঝাবার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ক্রমে আইডিওলজিবিহীন পার্টির এই সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ত্ব করার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সিপিএম নিজেই রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সে নিত্যদিন নানান ধরনের ভায়োলেন্স করার মাধ্যমে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে রাখত। বিরোধীদলের কর্মী ও সমর্থকদের হ্যারাস করা, ঘর জ্বালানো, হত্যা করা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। এমনকি তার শরিক দলের ক্যাডারদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতো। সিপিএম শুধু বিরোধী দলের কাছে নয়, শরিক দলের কাছেও তাদের সুপ্রিম্যাসি বজায় রাখতো।
এইভাবে সিপিএম এবসোলিউট ক্ষমতা ভোগ করতো। যার পরিণতিতে পার্টির অভ্যন্তরে সংক্রামিত হয়ে যায় দুর্নীতি। পঞ্চায়েতের পরিচালকদের প্রতি সাধারণের মানসিকতা ক্রমশ বিরূপ হতে থাকে। পঞ্চায়েতের বেনিফিট ভাগাভাগিটা ক্রমশ সহিংস হয়ে উঠতে থাকে আরো বেশি করে। এভাবে তাদের শাসন পশ্চিমবঙ্গকে পার্টির ভিত্তিতে পোলারাইজড করে দেয়। বিবাহের মতো সামাজিক ব্যাপারও পার্টির সমর্থক বা বিরোধী এর উপর নির্ভর করে সংঘটিত হতো।
রাজ্য পুলিশ পার্টির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করত। একুশে জুলাই ১৯৯৩ সালে যুব কংগ্রেসের ডাকা প্রতিবাদ মিটিংয়ে পুলিশ গুলি চালায়। তাদের ১৩ জন নিহত হয়। বাম জমানায় সংঘটিত আরো কিছু ঘটনার উদাহরণ, যেমন জানুয়ারি ১৯৭৯ এর মরিচঝাঁপি গণহত্যা, ৩০ এপ্রিল ১৯৮২ সালে ১৭ জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীকে পুড়িয়ে মারা, বীরভূমের সুচপুরে ২৭ জুলাই ২০০০ সালে ১১ জন শ্রমিক হত্যা। সবগুলোতেই সিপিএম অভিযুক্ত ছিল।
পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম গ্রামে যে হিংসা হয়েছিল তার মাত্রা ছিল তীব্র। স্পেশাল ইকনোমিক জোন (Special Economic Zone) ভিত্তিক শিল্প স্থাপনের জন্য জোর করে জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে সিপিএম ও কৃষক-জনতা (ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি) মুখোমুখি হয়ে যায়। ২০০৭-০৮ সালের এই ঘটনায় ৫০ জন নিহত হয়। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিকে ব্যাকআপ দেয় তৃণমূল কংগ্রেস। এই ঘটনা রাজ্যে পরিবর্তনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে যায়। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে টিএমসি সিপিএমকে পরাজিত করে।
৯।।
তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসলেও সহিংসতা চলতেই থাকে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি স্লোগান দিয়েছিলেন বদলা নয় বদল চাই। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দশ জন ব্যক্তি নির্বাচনেরে দিনে খুন হন। ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় শাসক দল। ২০১৯ এর নির্বাচনের প্রচারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গা হয়। বিজেপির কর্মীরা এতে অভিযুক্ত হয়। ২০১৯ এর পার্লামেন্টারি নির্বাচনের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেন বিজেপির ১৩০ জন নিহত হয়েছে। মার্চ এপ্রিল ২০২১ সালে আট দফায় বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। টিএমসি ব্যাপকভাবে জয় লাভ করে। বিজেপি দাবি করে তাদের ১০ জন কর্মী নিহত হয়েছে।
১০।।
গ্রাম বাংলার কৃষিতে শ্রম সম্পর্কের দ্বন্দ্ব
সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের দখলদারির মাধ্যমে গ্রামবাংলায় পার্টি হেজেমনি অলরেডি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছিল। সে সম্পদের অন্যতম ছিল কৃষি জমি। এই জমির দখলদারি এবং জমি কেন্দ্রিক শ্রম সম্পর্কের স্বরূপই পরবর্তীতে সিপিএম পার্টি আধিপত্যের অবসান ঘটায়। দীর্ঘ জমিদারী শাসনের অবসান ঘটলেও কংগ্রেস জামানা জুড়ে জমিতে বড় কৃষকের অধিকার তখনো অটুট। যদিও ষাটের দশকের নকশালপন্থী আন্দোলন সেই জমির পুনর্বন্টনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। ১৯৭২-১৯৭৭ পর্বে জমিতে বড় কৃষকের অংশীদারি ছিল ১.৩৬% মাত্র। এই তথ্য ১৯৮১ সালের NSSO (National Sample Survey Organization) সমীক্ষা অনুযায়ী। সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে মাঝারি অংশকে ব্যাপকভাবে ব্যাক আপ দিতে আরম্ভ করল। অল্প পরিমাণে বর্গাদার এবং খুব সামান্য পরিমাণে ক্ষেতমজুর উপকৃত হলো। কিন্তু প্রচারটা এমন হলো যেন মনে হলো ভূমি সংস্কার বিপ্লব এনে দিয়েছে। আদৗ ব্যাপারটা তেমন হয়নি। ছোট্ট একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এখানে। সরকারি হিসাব মতো ১৯৮১ সালে বড় কৃষক ছিল মোট হাউজহোল্ডের ১.৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ তারা প্রায় ১৪ লক্ষ হেক্টর জমির মালিক ছিল। ভূমি সংস্কার আইনের নির্ধারিত শিলিং অনুযায়ী এই কৃষকদের দশ একরের বেশি জমি থাকতে পারেনা। সেই হিসেবটি মাথায় রাখলে বন্টনযোগ্য জমির পরিমাণ হয় ৪ লক্ষ হেক্টর। এই জমি ক্ষেতমজুরদের মধ্যে বিলি হবার কথা। কিন্তু আদৌ তা করা হয়নি।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো রাজ্যের শ্রমশক্তির প্রধান অংশটাই ছিল ভূমিহীন ক্ষেতমজুর। বামফ্রন্ট সরকার তাদের দীর্ঘ শাসন আমল জুড়ে কৃষি মজুরি অত্যন্ত লো (Low) করে রাখতে চেয়েছিল। ওড়িশা, বিহার প্রভৃতি রাজ্যেও যখন কৃষি মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে তখনও তথাকথিত কমিউনিস্ট শাসিত পশ্চিমবঙ্গে তা স্ট্যাগনেন্ট অবস্থাতেই ছিল। কেন? এই কেন’র মধ্যে নিহিত আছে সেই শাসনের পতনের বীজ। আসলে তা ছিল মধ্য কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ভূমিহীন ও ক্ষেতমজুরদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া। অথচ পঞ্চায়েত এবং কৃষক সভাগুলির মধ্য দিয়ে এমন বাঁধনে তাদেরকে বেধে রাখা হয়েছিল যাতে তাদের এই বোধ হয় যে পার্টি তাদের স্বার্থ সুরক্ষা করছে।
সরকারের প্রথম দিকটাই ছোট মাঝারি কৃষকরা সাপোর্ট করেছিল কিন্তু ৮০ দশকের শুরু থেকেই পার্টির অভ্যন্তরে জোতদাররা জায়গা করে নিতে শুরু করেছিল এবং ক্রমশ পার্টি ক্ষমতা করায়ত্ব করেছিল। পরিণামে পরবর্তীকালে এই অংশের কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষা করাই পার্টির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যার ফলে ক্ষেতমজুরদের প্রশ্নটি পেছনের সারিতে চলে গিয়েছিল। এবং ক্রমে ক্ষেতমজুরদের বামফ্রন্ট শাসন সম্পর্কে মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। এবং তারা ৯০ দশকের পরবর্তী সময় থেকেই উদীয়মান পলিটিকাল শক্তি তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেন। এই প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয় যখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে জমি অধিগ্রহণ করবার ব্যাপারটি সামনে এসে যায়। SEZ (Special Economic Zone) অর্থাৎ বিশেষ অর্থনৈতিক শিল্পাঞ্চল তৈরি করবার জন্য কর্পোরেটদের আহ্বান করা হয়। সম্মুখ সমরে এসে যায় কৃষক স্বার্থ বনাম কর্পোরেট স্বার্থ। ইতিমধ্যে পার্টির অভ্যন্তরে কৃষি অলাভজনক হবার প্রেক্ষায় কর্পোরেট ওকালতি বেশ ভালো রকম জড় গেড়ে নিয়েছিল। যাইহোক এইখানে আরেকটি কথা উল্লেখযোগ্য যে ভূমিহীন ক্ষেতমজুরদের মজুরি কম থাকবার কারণেই আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এ রাজ্যের সব পরিবার থেকে প্রথমে কলকাতা এবং পরবর্তীতে ভিন রাজ্যে কৃষি শ্রমিকরা পরিযায়ী হতে শুরু করে। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
১১।।
নির্বাচনী আধিপত্য: পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল
পার্টি সংগঠনের ক্ষমতা বৃদ্ধি নির্বাচনে জয়লাভ এবং গ্রাস রুট লেভেলে আপন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা প্রায়শই রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে সহিংসতা ডেকে আনে। এভাবে ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশক জুড়ে পঞ্চায়েতের নির্বাচন সহিংস যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। আগেই বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা মানেই জীবনের সর্বত্র হস্তক্ষেপের সুযোগ। এই পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করতে পারলেই আধিপত্য বিস্তার করার সুযোগ ঘটে। তাই ক্ষমতা সংহত করতে সন্ত্রাস অনস্বীকার্য। আর এই বিষয়টি সিপিএম অত্যন্ত সুচারুভাবে করত বলেই এর শক্তি সম্পর্কে এতটাই সে সচেতন ছিল যে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হলেও তার যতটা না দুঃখ ছিল, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলের ভোটলুঠ তাদের কাছে অনেক বেশি শোকাবহ ছিল। সেই শোক ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বজায় থেকেছে!
২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছিল শাসক দল। ১৯৭৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয়:
সূত্রঃ টাইমস অব ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার অনলাইন
১২।।
সম্পদের ওপর দখলদারি ও তোলাবাজি
আগেই বলা হয়েছে বাম জমানায় সরকারি ওয়েলফেয়ার স্কিমের বেনিফিট পেতো তারাই যারা পার্টির আওতায় থাকতো। যেহেতু গরিব মানুষেরা তাদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য এসমস্ত প্রকল্পগুলোর উপর নির্ভরশীল ছিল তাই সিপিএম পার্টি কর্মীরা সরকারি প্রকল্পগুলোর উপর টাইট হোল্ড বজায় রাখত। এবং তা করতে গিয়ে বিরোধী গোষ্ঠী বা দলের সাথে সংঘর্ষ অনিবার্য হত।
আরেকটি বিষয় ছিল তোলাবাজি। পার্টির দাদারা খুশি না হলে কোনো কনস্ট্রাকশন কাজ বা কোনো প্রপার্টি ক্রয় বিক্রয় করা সম্ভব ছিলনা। সেগুলি করতে হলে তাদের মাধ্যমে করতে হতো। এভাবেই তোলাবাজির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল বাম জমানায়। টিএমসি জমানায় তা সর্বোচ্চ রূপ লাভ করেছে। এই সিন্ডিকেটরাজ এবং তোলাবাজি বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সহিংসতার জন্ম দেয়।
১৩।।
ভয়ের রাজনীতি : সহিংসতার ধরণ
বেকার যুবক রাজনৈতিক ফুটসোলজার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাদের নিরাপত্তা, সামাজিক প্রতিষ্ঠার গ্যারানটার ছিল পার্টি। অতএব বিরোধী পার্টির ক্যাডারদেরকে ‘শান্ত’ করবার কাজে তাদেরকে লাগানো হতো। যেহতু পার্টি আনুগত্যটাই প্রধান ব্যাপার তাই বিরোধের অপরাপর ক্ষেত্রগুলি ছিল গৌণ— যেমন জাতপাত, সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্ট ইত্যাদি পার্টির অভ্যন্তরের দ্বন্দ্ব হিসেবে সুপ্ত থাকতো।
প্রথমদিকে সিপিএম-কংগ্রেসের সহিংসতাকে জমিদার ও কৃষকের দ্বন্দ্বের অভিব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিল। আজকের দিনে টিএমসির বিজেপি বিরোধিতায় হিন্দু-মুসলিম ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ। টিএমসি বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক বলে আক্রমণ করে এবং পরোক্ষে মুসলিমদের বন্ধু সাজে। বিজেপি তাকে মুসলিম তোষণের অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং মেজরিটি হিন্দুভোট কনসোলিডেট করতে সক্ষম হয়। এতে ২০১৯ এর পার্লামেন্টারি ইলেকশনে সে অনেকগুলি আসন লাভ করে।
১৪।।
বিজেপির উত্থান ও নতুন ধরনের সহিংসতা
২০১১ সালে টিএমসি ক্ষমতায় এসে সিপিএমের প্র্যাকটিস গ্রহণ করে। নানাভাবে সিপিএমের ক্যাডার আক্রান্ত হয়। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ইলেকশনে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। সিপিএম সমর্থকরা আত্মরক্ষার জন্য বিজেপিতে যোগদান করতে থাকে এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে সিপিএমের প্রায় সমস্ত সদস্য সমর্থকরা বিজেপিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়। এর পেছনে শুধু সিপিএমের আত্মরক্ষা তত্ত্ব ছিলনা, পার্টির 'আগে রাম পরে বাম' ব্যাপার-স্যাপারও ছিল।
যাহোক পরে বিজেপি রামনবমী, মহরম ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারগুলিকে তীব্র করতে শুরু করে। রাজ্য রাজনীতিতে টিএমসি-বিজেপি বাইনারি এসে যায়। পূর্বতন শাসকদল তৃতীয় পজিশনে এসে যায়। কিন্তু সহিংসতা একই রূপেই বজায় থাকে। কারণ একই লোকেরাই সহিংসতার বৃত্তে ঘোরাঘুরি করে। সিপিএমের ক্যাডারবেস প্রথমে টিএমসি পরবর্তীতে বিজেপিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়। যে অনুপ্রবেশ উভমুখী প্রক্রিয়ার মতো লেগেই রয়েছে। ফলে পার্টিগুলির ভায়োলেন্স কালচার তাদের কাছে জানা-বোঝা জলভাতের মত। দ্বিতীয়তঃ বিজেপি কেন্দ্রের শাসকদল বলে তাদের অর্থবল এবং সাংগঠনিক শক্তি যথেষ্ট বেশি। ফলে তারা টিএমসিকে ভালো ভাবে টেকেল করতে পারবে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কোচবিহারের শীতলকুচিতে বিনা প্ররোচনায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলি চালনায় চারজন সাধারণ ভোটার নিহত হয়। এই ঘটনায় প্রমাণ হয় কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়বার ব্যাপারটি।
১৫।।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সহিংসতার ব্যতিক্রমী প্রকৃতি :
১) পার্টিজান ইন্টারেস্ট, বিরোধীদের উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার।
২) মতাদর্শবিহীন সহিংসতা। কেরালায় যেমন বিজেপি ও সিপিএমের মধ্যে সহিংসতার একটি আইডিওলজিক্যাল ভিত্তি আছে। তা এখানে নেই।
৩) উত্তর প্রদেশ বিহার রাজস্থান মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যে সহিংসতার মূলে আর্থসামাজিক বিরোধের নানা ফ্যাক্টর কাজ করে যার মধ্যে সাম্প্রদায়িক সেন্টিমেন্ট একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে অন্য সব গৌণ হয়ে যায় কেবলমাত্র পার্টি আনুগত্যের তলায়। এখানে সহিংসতা পার্টি লয়ালটি বা পার্টি বিরোধী এই ডিসকোর্সের মধ্যে পরিচালিত হয়। এই পয়েন্টে রাজনৈতিক সহিংসতা পশ্চিমবঙ্গে ভিন্নমাত্রা অর্জন করে।
৪) পশ্চিমবঙ্গে পার্টি সোসাইটির নানা শর্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় ভূমিকা নেয়। অতি সহজেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পার্টি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। দৈনন্দিন সন্ত্রাস এভাবেই পশ্চিমবঙ্গে একটা স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্সের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
সূত্র:
1.Understanding the Unique Nature of Political Violence in Bengal : Ambar Kumar Ghosh & Niranjan Sahoo.
2.Why are Rural elections in West Bengal so violent? : Shoaib Daniyal, Scroll.in, July 10, 2023
3.Political Economy of 'Middleness' : Behind Violence in Rural West Bengal; Dipankar Basu, Economic & Political Weekly, April, 2001.
- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -
সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন
গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১
পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক
নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার
সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ
RNI Ref. Number: 1343240
সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮
azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com