ষষ্ঠ বর্ষ। প্রথম সংখ্যা জানুয়ারি - মার্চ ২০২৪

গল্প

আঁচ

মাঝেরহাট থেকে ইডেন গার্ডেন যাওয়ার স্টাফ স্পেশাল ট্রেনের জন্য 5 নম্বর প্লাটফর্মে করোনা ভয় সত্ত্বেও দলে দলে লোক দাঁড়িয়ে আছে। দুজন শাকসবজির আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে কথা বলছে। বলছে, কৃষকরা এবার প্রচুর দাম পাচ্ছে। আমরা চাকুরিজীবী মানুষ, কী করে এত দাম দিয়ে শাকসবজি কিনব । এই ব্যাপারে সরকার কেন নজর দিচ্ছে না? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অমিত তাদের গল্প শুনতে থাকে। অমিতকে দেখে ওই ব্যক্তি বলে, কী বলো ভাই, শাকসবজির এত দাম! আলু 35 টাকা কেজি, পিয়াজ 40 টাকা কেজি। আগুন লেগেছে বাজারে। শাকসবজিতে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। কৃষকরা দাম পাচ্ছে আর আমরা চাকুরিজীবী মানুষ, মাইনে ছাড়া তো আর আমাদের তেমন কিছু নেই। তাতে কি সংসার চলে। দিদি বলছে আলু কুড়ি টাকা কেজি। কোথায় আলু কুড়ি টাকা? দিদির কথা কেউ শোনে?

সাড়ে 10 টার ট্রেন চলে আসে। সকলেই ট্রেনে ওঠে পড়ে। চা্কুরিজীবী দুজন সামনের ভেন্ডরেই উঠে বসে। অমিত ওদের সামনে হ্যাঙ্গার ধরে দাড়িয়ে থাকে। চাকুরিজীবী দুজনের গল্প ট্রেনেও চলতে থাকে। তাদের পাশের সিটে পরনে পরিষ্কার সাদার মধ্যে নীল সরু ডোরা কাটা জামা, আগের দিনের ঢোলাঢালা কালো প্যান্ট সঙ্গে খাকি রঙের খাদির বেল্ট দিয়ে ইন করা, পায়ে কালো ফাইবারের হালকা চটি যার আঙ্গুলের আংটি কাটা, গোড়ালির দিকটা ক্ষয়ে খুব পাতলা হয়ে গেছে। কালো বর্ণের 45 বছরের এক মানুষ শুষ্ক জড়ো হওয়া ত্বক, বকরা চোয়াল দেখে মনে হচ্ছে 60 বছরের বৃদ্ধ।

–বাবু, আমি আলু বেঁচেছি 150 টাকা প্যাকেট আর পেঁয়াজ বেঁচেছি 8 টাকা কেজি। আমি তো দাম পাইনি? আমি 7 বিঘা জমি চাষ করি। আমি, আমার বউ আর ছেলে প্রায় দিনরাত জমিতে কাজ করি। কোনো রকমে দুবেলা খাবার জোটে। ছেলেটাকে পড়াতে পর্যন্ত পারলাম না। দেখুন না আমার নাতনি খুব অসুস্থ, সাহায্য তো দূর গাড়ি ভাড়াটাও নেই। তাই একটু সেজেকুজে এই (স্টাফ স্পেশাল) ট্রেনে চেপেছি।

–পাচ্ছেন না তো সবজির এতো দাম কী করে হচ্ছে?

ভদ্রলোকের কথা শুনে অমিত বলে, কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছে না। দাম পাচ্ছে বিক্রেতা আর ক্রেতার মধ্যভোগীরা। মধ্যভোগীরা ফসল ওঠার সময় ফসলের দাম কমিয়ে মজুত করছে আর দেড় দুমাস যেতে না যেতেই ফসলের দাম আকাশ ছোঁয়া। প্রশাসন মধ্যভোগীদের কিছু বলছে না । তাদের মজুত খাদ্য সিজ করছে না। হিম ঘরগুলো সিল করছে না। কারণ কেন্দ্র সরকারের দল বা রাজ্য সরকারের দল তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পায়।

বিপরীত দিকে বসে থাকা গৌর বর্ণের, গণেশের মতো ভুঁড়ি, চোখে কালো চশমা, সাদা রঙের মেটাল ঘড়ি বারবার হাত ঝাকিয়ে ঠিক করছে আর তার বন্ধুকে বলছে, দিদিই ট্রেন চালানোর পারমিশন দিচ্ছে না। তার জন্যই সকলকে দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

অমিতের কথোপকথন শুনে গৌর বর্ণের ব্যক্তি অমিতের পাশের হ্যাঙ্গার ধরে দাঁড়িয়ে কৃষকের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কৃষি বিল পাস করেছে। কৃষকরা এবার স্বাধীনভাবে ফসল বেচতে পারবে। কৃষক হা করে শুনতে থাকে। কিছুই বুঝতে পারছে না।

গৌর ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আর কৃষক নিয়ে বলার মধ্যে ছেদ টানার জন্য তার দিকে ঘুরে অমিত

বলেন, একটু আগে আপনার বন্ধুকে বলছিলেন, দিদি ট্রেন চালানোর পারমিশন দিচ্ছে না । আপনি বলেন পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আর কোথায় সাধারণ নাগরিকের জন্য ট্রেন চলছে? শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন চালানোর জন্য রাজ্য সরকারের কি কোন পারমিশন লেগেছিল? রেল কেন্দ্র সরকারের, তাতে রাজ্য সরকারের করার কী আছে?

অমিতের কথা শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে কৃষকের কথা বন্ধ করে গৌরবর্ণ ব্যক্তি বলে, মুম্বাই চলছে?

অমিত তার চোখে চোখ রেখে বলে, সেটা কি সাধারণ নাগরিকের জন্য? আর কোন কোন রাজ্যে সাধারণ নাগরিকের জন্য ট্রেন চলাচল করছে? কেন চলছেনা? চা্কুরিজীবীদের অফিস যেতে হচ্ছে, সাধারণ নাগরিকদের কাজে বের হতে হচ্ছে। যাত্রীবাহী গাড়িতে সাধারণ মানুষ ঠাসাঠাসি করে বাঁদরঝোলা করে যাতায়াত করছে । কোথাও কি ডিসটেন্স মেনটেন করা যাচ্ছে? নাকি ট্রেন বন্ধ রাখার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে?

বিনাবাক্যে শুনতে থাকা গৌরবর্ণ ব্যক্তির বন্ধু অফিস ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অমিতের পাশে হ্যাঙ্গার ধরে দাঁড়িয়ে বলে, তাইতো! দেশে কোথাও তো সাধারণ নাগরিকের জন্য ট্রেন চলছে না। মিথ্যে কথা বলতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ায় নিরীহতার ভান করে নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

গলা দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসার মত করে অমিত আবার বলে, কৃষকদের যে স্বাধীনতার কথা বলছেন, সেখানে আমি একটু বলছি, আমাদের দেশের মোট ফসলের মাত্র 6 শতাংশ সরকার কৃষকদের থেকে কেনে। এই সরকারই মাণ্ডিগুলির সংস্কার আর সংখ্যা বৃদ্ধি না করে সেগুলোর উপর আরো বিভিন্ন প্রকার কর বসিয়ে সেগুলিকে ধ্বংস করে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে। তাতে বেসরকারি সংস্থাগুলি ফসল মজুত রেখে কৃত্রিমভাবে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য 99গুন বৃদ্ধি করতে পারবে। আপনি বলুন আমাদের দেশের কতজন কৃষক পশ্চিমবঙ্গ থেকে উড়িষ্যা, পাঞ্জা্‌ব, উত্তর প্রদেশ গিয়ে ফসল বিক্রি করতে পারবে? স্বাধীনতা! ওরা তো নিজের গ্রাম ছাড়া অন্য গ্রামে গিয়েই ফসল বিক্রি করতে পারে না। আর হ্যাঁ আপনাদেরও তো স্বাধীনতা রয়েছে 50, 60 km গিয়ে গ্রামের কম দামের বাজারে গিয়ে ফসল কেনার, সবজি কেনার। তাতে আপনাদেরও আগুনের ছ্যাকা লাগবেনা, টাটকা সতেজ সব পাবেন আর কৃষকরাও সরাসরি দাম পাবে।

দরিদ্র কৃষকটি অমিতের সব কথা শুনে দাঁড়ানোর জন্য হ্যাঙ্গার ধরার চেষ্টা করে কিন্তু হাতে না পেয়ে ট্রেনের গায়ে হাত দিয়ে দাড়ায়। সকলের মধ্যে নিস্তব্ধতা আসে। শুধু লোকাল ট্রেনের বিকট আওয়াজ শোনা যায়। ইডেন গার্ডেন স্টেশনে ট্রেন থামলে সবাই নেমে যায়।

 

:: ভয়েস মার্ক ::

- দ্বি-মাসিক পত্রিকা -

সম্পাদক: মোঃ আযাদ হোসেন

গ্রাহক পরিষেবা: রনিক পারভেজ, ৯৩৭৮৪৮০১৯১

পাণ্ডুলিপি (ম্যানুস্ক্রিপ্ট) প্রস্তুতি ও সম্পাদনা : মোঃ মিনারুল হক

নামলিপি ও প্রচ্ছদ চিত্র: হিমাদ্রী শেখর মজুমদার

সত্বাধিকার: ভয়েস মার্ক কালচারাল গ্রূপ

RNI Ref. Number: 1343240

-: যোগাযোগ :-

সম্পাদকীয় দপ্তর:
ভগবানপুর , আষাঢ়িয়াদহ
লালগোলা, মুর্শিদাবাদ
পিন - ৭৪২১৪৮

azadm.1981@gmail.com, voicemark19@gmail.com

:: সামাজিক মাধ্যম ::